x 
Empty Product

দেশে বাণিজ্যিকভাবে আমের উৎপাদন, কেমিক্যালমুক্ত পরিচর্যা এবং রফতানি বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে গাছে মুকুল আসা থেকে শুরু করে ফল পরিপক্বতা অর্জন, আহরণ, গুদামজাত, পরিবহন এবং সারা দেশে বাজারজাতের পাশাপাশি উদ্বৃত্ত আম রফতানি কার্যক্রমেও সরকারের নিবিড় তদারকি থাকবে। ভোক্তার সুরক্ষা নিশ্চিত, রফতানি মান ধরে রাখা এবং চাষীর মুনাফা নিশ্চিত করতেই এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ জন্য মৌসুম চলাকালীন সারা দেশে আমবাগানগুলো স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিতে রাখা হবে। চাষীরাই বাগান করবেন। এর মালিকানায়ও থাকবেন চাষীরা। তবে বাগানে গাছ ও মুকুলের সুষ্ঠু পরিচর্যা, সর্বোত্তম ফলন এবং বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ প্রতিরোধেই এ সময়ে বাগানগুলো স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা তদারকি করবেন। একই সঙ্গে বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ ঠেকাতে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্রমতে, ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়ে এ ব্যাপারে একটি গাইডলাইন জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই আমের মুকুলে বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ করা যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজন হলে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ করা যাবে। তবে তা প্রয়োগের কমপক্ষে সাত দিনের মধ্যে ফলন খাওয়ার জন্য বাজারজাত করা যাবে না। নির্দেশনায় একটি নির্দিষ্ট সময় নিয়ে পরিপক্ব না হওয়া পর্যন্ত গাছ থেকে চাইলেই আম আহরণ করা যাবে না। বাগান পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের এসব তদারকি নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসক, থানা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং স্থানীয় কৃষি অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় যৌথ সভাও করা হয়েছে। এ সভার মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার আমচাষীদের কাছে এসব বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চাষীদের এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ভালো ফলন পাওয়ার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুসারে রফতানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে সুস্বাদু ও রসালো আমকে গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য হিসেবে বিবেচনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশের সীমিতসংখ্যক বাগানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম উৎপাদন হলেও এই উৎপাদিত আমই চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরে স্বল্প পরিসরে রফতানি হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে, একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনে চাষীরা পরিচালিত হলে এবং তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি প্রশাসনিক নজরদারি থাকলে তাতে সবদিক থেকেই লাভবান হওয়া সম্ভব। এটি নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে সারা দেশে আমবাগানগুলোর তদারকি কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও চলতি মাসের প্রথম দিকে সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলকার আমবাগান পরিদর্শন করেছে। মৌসুমের বাকি সময়েও আমের জন্য প্রসিদ্ধ জেলাগুলোর আমবাগান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হবে।

জানা গেছে, বিশ্বে আম উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। বর্তমানে দেশে বার্ষিক উৎপাদিত আমের পরিমাণ ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৩০ টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশে উৎপাদিত আমের চাহিদা মেটানোর পরও ৭০ শতাংশ উদ্বৃত্ত আম রফতানির সুযোগ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব আম রফতানি করে খুব সহজেই ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের মতো আম রফতানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করতে পারবে। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা, উন্নত প্যাকিং ও বিপণন ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে রফতানির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও নানা সমস্যার কারণে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হচ্ছে না। জানা গেছে, গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে রফতানি করার পর ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আম নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত চেন শপ ওয়ালমার্ট এ বছরও বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ আম আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি তারা জানিয়ে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির এই আগ্রহ এবং জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশের আমবাগানগুলো পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে ফলের অবদান কম নয়। তবে ফলের আওতায় মোট আবাদি-চাষভুক্ত জমির পরিমাণ ১.৬৬ ভাগ। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসলভিত্তিক আয়ের প্রায় ১০ ভাগ আসে ফল থেকে।

সুমিষ্ট আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম এবার সরকারি পর্যায়ে বিদেশে রফতানির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র থেকে পাঠানো আমের নমুনা ইউরোপীয় ইউনিয়নে গৃহীত হওয়ায় স্বনির্ভর অর্থনীতির নতুন এই সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে চলেছে। এর ফলে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুস্বাদু আম ইউরোপে রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতি বছর দেশে উত্পাদিত মোট আমের সিংহভাগই উত্পাদিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। জেলায় এখন আমের আবাদকৃত জমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২২ হাজার হেক্টর। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৬ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন আম উত্পাদিত হয়। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতেই উত্পাদিত হয় ২ লাখ মেট্রিক টন। এই বিপুল পরিমাণ আম শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশে উপহার হিসেবে পাঠানো ছাড়া কখনই রফতানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রতি বছর ৪১ হাজার মেট্রিক টন আম বিদেশে রফতানি করে থাকে। এমনকি পাকিস্তানও প্রতি বছর গড়ে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন আম বাইরে পাঠায়। ভারত ও পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশে উত্পাদিত আমও বিদেশে রফতানির জন্য সরকারি কৃষিজ উত্পাদন রফতানিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান হরটেক্স ফাউন্ডেশন বারবার চ্যানেল সৃষ্টির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় জাপান ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। সে হিসেবে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জাপানে আম রফতানির চেষ্টা করে সরকারি উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে জাপান অনাগ্রহ দেখালেও তাদের কাছে আমের নমুনা পাঠানো হয়। হরটেক্স ফাউন্ডেশন গত ৩০ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত বারি-২ জাতের আমের নমুনা বাবদ প্রায় ২০ কেজি আম পাঠিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে। এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এক ফ্যাক্স বার্তার মাধ্যমে জানানো হয়েছে, উত্কৃষ্টমানের এই আমের নমুনা তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। প্যারিস থেকে পাঠানো এই ফ্যাক্স বার্তাটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে এসে পৌঁছলে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফল বিজ্ঞানী মোঃ সরফ উদ্দিন জানান, এই প্রথমবারের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত বারি-২ আম বিদেশে রফতানির যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর ফলে বিদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম রফতানির একটি বড় ধরনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এদিকে বিদেশে রঙিন জাতের আমের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ২০০৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে আয়োজন করা হয়েছিল রঙিন জাতের আম প্রদর্শনী। এখানে প্রদর্শিত ৮৭ জাতের আমের মধ্যে ৩৩টি জাতকে উত্কৃষ্টমানের বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এসব জাতের রঙিন আমকে বিদেশে রফতানির জন্য গুণগতমান নিশ্চিত করতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।